মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৫:৫৩ পূর্বাহ্ন

কিছু কর্মকর্তার কারণে ইমেজ সংকটে পুলিশ

কিছু কর্মকর্তার কারণে ইমেজ সংকটে পুলিশ

স্বদেশ ডেস্ক;

দেশে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে পুলিশকে মানবতার বারতা নিয়ে মানুষের পাশে থাকতে দেখা গেছে। কর্মহীন মানুষকে খাদ্য সহায়তাসহ নানাভাবে দেশজুড়ে পুলিশ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কতিপয় পুলিশের অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকা-ের কারণে পুলিশের সেই অর্জন ম্লান হোক এটা আমরা চাই না। কতিপয় পুলিশ চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, নির্যাতন, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে গোটা পুলিশ বাহিনীর ইমেজ বা ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।

পুলিশের সবচেয়ে বড় ইউনিট ঢাকা মহানগর পুলিশ। প্রায় ৩৫ হাজার সদস্য ডিএমপিতে নানা পদে কাজ করছেন। এই ইউনিটে পুলিশের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির খবর রাখতে একজন ডিসির নেতৃত্বে একটি বিভাগই রয়েছে। গত বছর এই ইউনিটে এক হাজার ৯০১ পুলিশ সদস্য লঘু ও গুরুদ- পেয়েছেন। তার মধ্যে লঘু শাস্তি পেয়েছেন এক হাজার ৫৯৩ জন। বড় শাস্তি হয়েছে ৩০৮ জনের। আর মাদকে জড়িয়ে পড়াসহ নানা অপরাধে এক বছরে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ২৬ পুলিশ সদস্যসহ ৮০ জনকে। শাস্তির মুখোমুখি বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য নিম্নপদে কর্মরত।

ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়িকা পরীমনির সঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি গোলাম সাকলায়েনের প্রেমের সম্পর্ক, সাকলায়েনের বাসায় পরীমনির ১৮ ঘণ্টা কাটানোসহ সংশ্লিষ্ট আরও বেশকিছু ঘটনা পুলিশকে চরমভাবে বিব্রত করে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে সাকলায়েনকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ থেকে সরিয়ে পুলিশ অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) বদলি করা হয়।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েনের এ ঘটনাকে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তারা এও বলেছেন, ঘটনাটি পুলিশ বাহিনীর জন্য লজ্জার। একটি মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা হিসেবে ভিকটিমকে এভাবে নিজ বাসায় ডাকা এবং একসঙ্গে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান নীতি-নৈতিকতার জায়গা থেকে করা যায় না। সাকলায়েনের ওই ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে তদন্ত কমটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু এখনো তদন্তের ফল জানা যায়নি।

ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মাসুদ করিম আমাদের সময়কে বলেছেন, তারা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। তদন্তের শেষপর্যায়ে অভিযোগের বিষয়ে এডিসি সাকলায়েনের বক্তব্য নেবেন। তদন্ত এখনো চলমান রয়েছে বলে তিনি জানান।

এদিকে সাকলায়েনের ওই ঘটনা কেন্দ্র করে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার কারণে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সার্বিক কার্যক্রম অনেকটাই থিতিয়ে গেছে। গত কয়েকদিন যে কোনো অভিযানে কোনো টিম পাঠানোর আগে ডিবির কর্ণধাররা সতর্কতা অবলম্বন করছেন।

চিত্রনায়িকা পরীমনির সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েনের সম্পর্কের ঘটনার রেশ না কাটতেই এক স্বর্ণব্যবসায়ীর স্বর্ণ আত্মসাৎ করে গ্রেপ্তার হয় ফেনী জেলা ডিবি পুলিশের ওসি ইন্সপেক্টর সাইফুল ইসলামসহ ৬ পুলিশ সদস্য। গ্রেপ্তারের পর বুধবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে আনা হয়েছে। তারা গ্রেপ্তারের পরই বেরিয়ে আসছে ইন্সপেক্টর সাইফুলসহ ওই ৬ পুলিশের নানা অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকা-ের অনেক তথ্য। দীর্ঘদিন ধরেই তারা মানুষকে ভয়ভীতি দিয়ে জিম্মি করে আর্থিক ফায়দা লুটে আসছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে ফেনী জেলার পুলিশ সুপার খোন্দকার নূরুন্নবী আমাদের সময়কে বলেন, দু-তিনজন পথভ্রষ্ট পুলিশের কারণে আমরা গোটা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ হতে দেব না। এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হবে। আইন যে সবার জন্য সমান, সেটা আমরা ইতোমধ্যে ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে সেই বার্তাটি দিয়েছি।

বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে প্রায় সোয়া দুই লাখ সদস্য কর্মরত। তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরতে পুলিশ সদর সদর দপ্তরের বিভিন্ন সেল এখন আগের চেয়ে আরও সক্রিয়। পুলিশ সদর দপ্তরের বাইরে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটেও অনুরূপ সেল কাজ করছে। প্রতি বছর গড়ে ১৮ থেকে ২৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আসে পুলিশ সদর দপ্তরে। এদের মধ্যে গড়ে প্রায় ২ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মে জাড়িয়ে পড়ার তথ্য পায় পুলিশ সদর দপ্তর। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় তাদের সাজা। তবে এদের মধ্যে একটি বড় অংশ তিরস্কার, ভর্ৎসনার মতো লঘুদ- পেয়ে পার পেয়ে যান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, এটা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে এটা বলব না। যে অনিয়মগুলো হয় সেগুলোর কোনো বিচার হয় না। বড়জোর ডিপার্টমেন্টাল কিছু অ্যাকশন হয়। যে কারণে এটি বিকশিত হতে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে এখন বেরিয়ে আসছে একের পর এক ঘটনা। এটি খুবই উদ্বেগজনক। গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য এটি সহায়ক নয়। যারা অপরাধে জড়ান তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গ্রহণ করতে হবে। পুলিশের অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে হবে। তা না হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা যতটুকু আছে সেটিও হারাবে।

এদিকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে থাকাকালে একজন নারী পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মোক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। ঘটনাটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে হলেও একজন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরেকজন নারী পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ধর্ষণের অভিযোগটি নিয়েও দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ ঘটনাও পুলিশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এ ঘটনাটি জোর আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে খোদ পুলিশ বাহিনীতেও। মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

স্বর্ণ, নগদ অর্থ, মুঠোফোন ও মালামাল লুট করার অভিযোগে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানার সাত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গত ৯ আগস্ট কুমিল্লার আদালতে ডাকাতি মামলা হয়েছে। তারা আসামি ধরতে গিয়ে স্বর্ণ, নগদ অর্থ, মুঠোফোন ও মালামাল লুট করেন বলে আদালতে দাখিল করা বাদীর আর্জিতে বলা হয়েছে।

স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সরকারি জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেছিলেন রাজশাহী নগরীর এক গৃহবধূ। কিন্তু বিচারপ্রার্থী গৃহবধূকে উল্টো যৌন নির্যাতন করেছেন পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা। গত রবিবার দুপুরে নগরীর বোসপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. শামীমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

বরিশালের উজিরপুর থানায় গত মাসে পুলিশ হেফাজতে রিমান্ডে থাক এক নারী আসামিকে যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতন করেন ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল হাসান ও ইনসপেক্টর মাইনুল। এই অভিযোগে ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করা হয়েছে।

ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশপ্রধান হিসেবে যোগদানের পর থেকে একাধিক সভায় পুলিশকে বাহিনীর সদস্যদের অপরাধ-অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে নানা নির্দেশনা প্রদান করেন। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেলে যে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না এই বার্তা দেন একাধিকবার। মাদকসংশ্লিষ্টতা থেকে পুলিশকে দূরে থাকতেও কঠোর বার্তা দেন। কিন্তু তার এই নির্দেশনা মাঠপর্যায়ের পুলিশের ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলছে এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।

গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেছেন, গুটিকয়েক পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো পুলিশ বাহিনীর সুনাম ক্ষুণœ হতে দেওয়া হবে না। পুলিশ সদস্যরা অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনসহ অন্যান্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। না হলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম শাখার ডিআইজি হায়দার আলী আমাদের সময়কে বলেন, প্রতিটি ঘটনাতেই আলাদা আলাদা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

অপরাধে জড়ালে ছাড় নয় : কেউ অপরাধ করে পার পাবে না, পার পাচ্ছে না। অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভা ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুলিশ বাহিনীর দুই একজন সদস্য অন্যায় করতে পারে। আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হচ্ছে। সম্প্রতি যেসব পুলিশ সদস্য বিভিন্ন অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে তাদেরও শাস্তি হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, তবে করোনায় পুলিশ বাহিনী উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। তাদের অনেক ভালো কাজ আছে। ১০ বছর আগের বাহিনী আর এখনকার বাহিনীর মধ্যে অনেক গুণগত পরিবর্তন হয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877